মনিপুরের মিতেইদের সাথে বাংলার সম্পর্ক
আপনারা সকলেই জানেন যে বেশ কিছুদিন যাবৎ ভারতের উত্তর পূর্বের ছোট রাজ্য মনিপুরে বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে খুব ঝামেলা চলছে, সংঘর্ষে প্রচুর মানুষ মারাও গেছেন। সংঘর্ষে প্রধানত দুইটি উপজাতির নাম সামনে এসেছে, মিতেই বা মেইতেই এবং কুকি। আজ আলোচনা করবো এই মিতেইদের নিয়েই, প্রসঙ্গত বলি এরাই কিন্তু মনিপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
----------------------
মনিপুরে ভগবান শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর দর্শন প্রথম সপ্তদশ শতাব্দীতে মহান ভক্ত শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুরের পাঁচ শিষ্য দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল। শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুরের গান এখনও মণিপুর জুড়ে গাওয়া হয় এবং তাঁর জন্মদিন এখনো ধুমধাম করে পালিত হয়।
![]() |
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু |
এরপর আসি রাজা ভাগ্যচন্দ্রের কথায়, এনার আমলেই মনিপুরে গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদ প্রচারলাভ করে।
রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র ১৭৫৯ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন, কিন্তু ১৭৬২ সালে বার্মিজরা, তার ঈর্ষান্বিত মামার সাথে একত্রে ষড়যন্ত্র করে মণিপুর আক্রমণ করে দখল করে। রাজা তার রানী এবং কয়েকজন পরিচারককে নিয়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্য অহোমে পালিয়ে যান, যা বর্তমানে আসাম নামে পরিচিত।
অহোমের রাজা রাজেশ্বর রাজা ভাগ্যচন্দ্রের গুণের কথা শুনেছিলেন এবং তাকে পেয়ে খুশি হয়েছিলেন। তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন এবং রাজেশ্বর ভাগ্যচন্দ্রের রাজপ্রাসাদে থাকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ভাগ্যচন্দ্রের ধূর্ত মামা রাজেশ্বরকে একটি চিঠি লিখে বলেছিলেন যে তাঁর দরবারে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিটি একজন প্রতারক, মহান ভাগ্যচন্দ্র নয়। উনি অহোমের রাজাকে পরামর্শ দেন ভাগ্যচন্দ্রকে হত্যা করতে। বার্তাটি রাজা রাজেশ্বরকে প্রভাবিত করেছিল বলে মনে করা হয়। পুরোপুরি রাজি না হলেও, তিনি ভাগ্যচন্দ্রের সাথে শীতলতা এবং সন্দেহের সাথে আচরণ করতে শুরু করেন। যেহেতু তাকে সরাসরি হত্যা করা সম্ভব নয় তাই মন্ত্রীদের পরামর্শে অহোমের রাজা রাজেশ্বর এক ফন্দি আঁটেন, ভাগ্যচন্দ্রকে বলা হয় রাজপুরীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে থাকা একটি বন্য হাতিকে বশ মানিয়ে নিজেকে সত্যিকারের ধার্মিক বলে প্রমাণিত করতে। যদি তিনি সফল হন তাহলে প্রমান হবে তিনি ধার্মিক কারণ সেক্ষেত্রে ঈশ্বর তাকে রক্ষা করবেন আর যদি তিনি ব্যর্থ হন তাহলে হাতিটি নিশ্চয়ই তাকে আক্রমণ করে মেরে ফেলবে এবং সেক্ষেত্রে প্রমান হবে যে তিনি একজন অধার্মিক।
এইরকম একটি অসম্ভব কাজে সফল হওয়ার জন্য রাজা ভাগ্যচন্দ্র ভগবান কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। তখন ভগবান কৃষ্ণ তাকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং তাকে মালা ও জপ পুঁতি হাতে নিয়ে মাঠে প্রবেশ করার পরামর্শ দেন। পরের দিন সকালে, জনতা মনিপুরের বিতাড়িত রাজার ভাগ্যপরীক্ষা দেখার জন্য ছাদে এবং গাছের ওপরে উঠে অপেক্ষা করেছিল। হাতিটি দূর থেকে গর্জে উঠে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আস্তে থাকে কিন্তু ভাগ্যচন্দ্রের কাছে যাওয়ার সাথে সাথে তার গতি কমতে থাকে এবং তারপরে তাঁর সামনে এসে নতজানু হয়ে যায় সেই হাতি। রাজা ভাগ্যচন্দ্র বলেছিলেন যে তিনি স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মাহুত হিসাবে দেখেছিলেন। এই অলৌকিক ঘটনার কথা ছড়িয়ে পরে চারপাশে। এই ঘটনায় রাজা রাজেশ্বর নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং তাকে সম্পূর্ণ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।
রাজা রাজেশ্বরের সাহায্য নিয়ে প্রথম বার ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় বারে সফল হয়ে উনি রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হন। ১৭৭৩ সালের ঘটনা এটি। তিনি রাজ্যটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা করে তার ছোট রাজ্যগুলিকে একটি রাজ্যে একত্রিত করতে শুরু করেন।
ভাগ্যচন্দ্রের মনিপুরী নাম ছিল রাজা চিং-থাং খোম্বা। কথিত আছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ওনাকে স্বপ্নাদেশে বলেন রাজ্য পুনরুদ্ধারের পর গোবিন্দের একটি মূর্তি স্থাপন করে নিত্যপূজা করতে। ভগবান নির্দেশ দেন কাইনা নামে পরিচিত একটি পাহাড়ের ঢালে বেড়ে ওঠা একটি নির্দিষ্ট পুরানো কাঁঠাল গাছ থেকে মূর্তিটি বানানোর এবং আরো বলেন উনি ভগবানের যেই রূপ তখন প্রত্যক্ষ করছেন সেইভাবেই যেন মূর্তিটি বানানো হয়। এরপরের কাহিনীও বেশ দীর্ঘ, সেই বিষয়ে আর যাচ্ছিনা। যাই হোক সেই কাঠ থেকে একের পর এক মূর্তি তৈরী করা হলেও তা রাজার মনঃপূত হচ্ছিলো না, শেষে কাঠটির অন্তিম অংশটি দিয়ে যে মূর্তিটি বানানো হয়, সেটি দেখে রাজা তৃপ্ত হন। শেষে ১৭৭৬ সালে ইম্ফলে শ্রী গোবিন্দ মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়।
![]() |
মনিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র |
এনার মেয়ের নাম ছিল বিম্বাবতী। জনশ্রুতি, বিম্বাবতীর যখন আট বছর বয়স তখন রাজবাড়ীর এক ধর্মীয় উৎসবে শ্রীরাধিকার অঙ্গরাগ অসম্পূর্ণ থাকায় সবাই যখন চিন্তিত তখন রাজপুরোহিত বিধান দেন সর্বসুলক্ষণযুক্তা বিম্বাবতীকে শ্রীরাধিকার জায়গায় শ্রীকৃষ্ণের পাশে বসিয়ে পুজোর অনুষ্ঠান করার। এরপর রাজার বহু চেষ্টা সত্ত্বেও বিম্বাবতী আর বিবাহের জন্য রাজি হননি, তিনি বলেন যে শ্রীগোবিন্দের সাথে তার বিবাহ তো হয়েই গিয়েছে! 'গোবিন্দ রাসেশ্বরী পালা' রচনা করেন বিম্বাবতী যা এখনো অনুষ্ঠিত হয় নবদ্বীপের মন্দিরে মন্দিরে। বিম্বাবতী, যিনি মণিপুরী রাস লীলা নৃত্যে প্রথম রাধার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, বাঙালি ধর্মপ্রচারকদের প্রভাবে তিনি মণিপুরে সংকীর্তনও শুরু করেন।
রাজা ভাগ্যচন্দ্র ছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের একজন প্রবক্তা শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুরের অনুসারী। তিনি শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুরের শিষ্য শ্রীল গঙ্গা নারায়ণ চক্রবর্তীর দ্বারা দীক্ষিত হন, যিনি ভাগবত সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে মণিপুরে গিয়েছিলেন। ১৭৯৮ সালে রাজা ভাগ্যচন্দ্র রাজনৈতিক জীবন থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কন্যা বিম্বাবতী, রাণী এবং কয়েকশত সহযোগী নিয়ে তিনি শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুরের জন্মস্থান মুর্শিদাবাদে তীর্থযাত্রার জন্য রাজ্য ত্যাগ করেন (১৭৯৮ সালের জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মাসে)। রাজা তার মণিপুর রাজ্য জ্যেষ্ঠ পুত্র লাবণ্যচন্দ্রের কাছে হস্তান্তর করেন এবং তার বাকি দিনগুলি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনাতেই কাটিয়ে দেন।
তিনি ১৭৯৯ সালের অক্টোবর মাসে (মতান্তরে ১৭৯৮ সালের ডিসেম্বরে) মুর্শিদাবাদে (মতান্তরে নবদ্বীপে) পরলোকগমন করেন। সেখানে শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুরের সমাধির কাছে তাঁর মৃতদেহ দাহ করা হয়েছিল। রাজার ইচ্ছা অনুসারে, তার ভস্মের একটি অংশ মণিপুরে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল এবং রাজপরিবারের পারিবারিক শ্মশানে সমাহিত করা হয়েছিল, এবং অন্য একটি অংশ শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান নবদ্বীপে আনা হয়েছিল।
![]() |
শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর |
শোনা যায়, ভাগ্যচন্দ্র তৎকালীন নবদ্বীপ অধিপতি মহারাজ ঈশ্বরচন্দ্রের কাজ থেকে বার্ষিক এক টাকা খাজনার চুক্তিতে ষোলো বিঘা জমির অধিকার পান। সেখানে তিনি অনুমহাপ্রভু নামের একটি চৈতন্য মূর্তি স্থাপন করে কন্যা বিম্বাবতীকে তার সেবাপূজার দায়িত্ব দেন (অন্য একটি মতে এই মন্দিরটি নাকি রাজা চৌরজিৎ সিংয়ের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল)। অদ্ভূত ব্যাপার এরপর আর বিম্বাবতীর কোনো উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায়না।
বিম্বাবতীর পর থেকে আজ পর্যন্ত এই রাজবংশের উত্তরাধিকারীরাই অনুমহাপ্রভুর সেবাপুজোয় নিয়োজিত। মনিপুর রাজাদের তিনটি মন্দির প্রাসাদ নিয়ে নবদ্বীপের মনিপুর অঞ্চল। ১) ভাগ্যচন্দ্রের পুরোনো রাজবাড়ী ২) মহারাজ চূড়াচাঁদ সিংয়ের নতুন রাজবাড়ী ও ৩) তার স্ত্রী ধনমঞ্জরীদেবীর নামে তৈরী সোনার মন্দির (বাংলা ১৩৮০ সন)।
![]() |
মণিপুরের মহারাজা চূড়াচাঁদ সিং এবং তার স্ত্রী মহারানী ধনমঞ্জরীদেবী |
এই চূড়াচাঁদ সিংও একসময় নবদ্বীপে এসেছিলেন ও বহুদিন এখানে বাস করেছেন। এনাদের কন্যা রাজকুমারী বিনোদিনী ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী। তিনি ছিলেন একাধারে গায়িকা, ভাস্কর, ঔপন্যাসিকা, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার। তিনি মণিপুরের প্রথম মহিলা যিনি স্নাতক হন। উনি ছিলেন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী রামকিঙ্কর বেজের ছাত্রী। ১৯৭৬ সালে তিনি ভারতীয় সঙ্গীত, নাটক, নৃত্য, চলচ্চিত্র এবং সাহিত্যে তার অবদানের জন্য পদ্মশ্রী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৯ সালে তার উপন্যাস "বোরো সাহেব ওংবি সানাতম্বী" প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির জন্য তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান। উনি ২০১১ সালে পরলোকগমন করেন। ওনার মৃত্যুর পরে মন্দিরগুলি অবহেলার শিকার হয়। মন্দির দেখভালের দায়িত্ব অন্যলোকেদের হাতে যাওয়ার পর তারা সোনার মন্দির প্রাঙ্গনের প্রধান প্রবেশতোরণ থেকে ধনমঞ্জরীদেবীর নাম পর্যন্ত নাকি বাদ দিয়ে দেন! ভাবুন একবার যিনি তৈরী করলেন তাকে নিয়েই এইরকম করা হলো!
![]() |
রাজকুমারী বিনোদিনী দেবী |
মিতেইদের প্রধান উৎসব
--------------------------------
য়াওশাং: এটি হোলির সময় পালন করা হয়। পাঁচ দিনব্যাপী উদযাপন শুরু হয় ‘য়াওশাং মেই থাবা' (একটি ছোট খড়ের কুঁড়েঘর) পোড়ানোর মাধ্যমে, যা প্রথম দিনে বাঁশ এবং খড় দিয়ে তৈরি করা হয়। উৎসবের বিশেষত্ব হল থাবালচংবা, একটি ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী লোকনৃত্য যেখানে ছেলে ও মেয়েরা হাত ধরে একটি বৃত্তে গান এবং নাচ করে। উৎসবটি জীবনের চেতনার পুনর্জাগরণকে চিহ্নিত করে এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মদিনকে স্মরণ করে।
নবদ্বীপে কখন মূলত এনাদের ভিড় হয়
--------------------------------------------------
সারা বছর ধরে নবদ্বীপে মিতেইদের আনাগোনা। দোল, রথযাত্রা, রাস প্রভৃতি উৎসবে ও মহালয়ার তর্পনের সময় মিতেইদের ভিড় এখানে খুব বেড়ে যায়।
তাহলে ভেবে দেখুন কোথায় আমাদের বাংলার নদীয়া-মুর্শিদাবাদ আর কোথায় সেই মনিপুর! ইতিহাস কিভাবে যে সবকিছুকে জড়িয়ে রাখে ভাবলেই অবাক লাগে| ছবিগুলি কিন্তু সব ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত।
#manipur #nabadwip #bhagyachandra #historical #westbengal #meitei
Comments
Post a Comment