হাওড়ার ডোমজুড়ের নারনা কালীবাড়ি

হাওড়া জেলার ডোমজুড় ব্লকের অন্তর্গত নারনা গ্রামে এই কালীবাড়ি অবস্থিত। সুপ্রাচীন এই মন্দির ২৫০ বছরেরও (মতান্তরে ৫০০) বেশি প্রাচীন।  দেবী এখানে কালী রূপে বিরাজমান, কিন্তু দেবী দুর্গা রূপেই পূজিতা হন। এই মূর্তি নাকি বানিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মূর্তির শিল্পী নবীন ভাস্কর, তাই মা ভবতারিণীর মূর্তির সঙ্গে যথেষ্ট মিলও রয়েছে নারনা কালীবাড়ির মূর্তিতে। 

মূল মন্দির

মূল ফটক

সিংহাসনে দেবতা সমাবেশ
-----------------------------

একদিকে ছবিতে দেখা যাচ্ছে সিংহের উপর দাঁড়িয়ে মহিষাসুরমর্দিনী। না, দুর্গা নয় মহিষাসুরমর্দিনী হলেও তিনি কালী। অন্য দিকের ছবিতে সিংহের উপর বসে তিনি বধ করছেন হাতিকে। দেখলেই চেনা যায় জগদ্ধাত্রী হিসেবে হাতি রূপী করিন্দ্রাসুর বধের মূর্তি। এছাড়াও সিংহাসনে রয়েছেন রয়েছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, রামচন্দ্রকে কাঁধে করে হনুমান, জয়া বিজয়া, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক।

বিগ্রহ

এত দেবতা একসঙ্গে কেন?
------------------------------

একটা সময় ছিল, এই মন্দির আর নিকটবর্তী পঞ্চানন্দ থান ছাড়া গোটা গ্রামে অন্য কোনও দেবতার পুজো নিষিদ্ধ ছিল। গ্রামবাসীদের মনে অন্য দেবতাদের পুজো করার ইচ্ছে জাগলেও তা তারা করতে পারতেন না। অবশেষে মায়ের মন্দিরে পুজো করলে কোনও ক্ষতি নেই এই ভেবে সব দেবতাদেরই মূর্তি স্থাপন করা হয় এই মন্দিরের বেদীতে। পার্শ্ববর্তী চাঁদডাঙার মাঠ নাকি ছিল তন্ত্রসাধকদের সাধনস্থল।

মন্দির প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জনশ্রুতি 
---------------------------------------

এই গ্রামের সরখেল পরিবারের হাতেই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে জানা যায়। তখনও ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়নি। যে কালীপুকুরে মা কালীর স্নানের কিংবদন্তি প্রচলিত সেই পুকুরেই একদিন সকালে স্নান করতে নেমে একটি ঘট খুঁজে পান সরখেল পরিবারের কোনও পূর্বপুরুষ। সিঁদুরমাখা ঘট দেখে তুলে আনেন তিনি। সেই রাতেই মেলে মায়ের স্বপ্নাদেশ। ওই ঘটেই শুরু হয় মায়ের পুজো। কিছু বছর পরে মাটির মূর্তি গড়ে পুজো শুরু হয়। এরপর কেটে গেছে বেশ কিছু সময়। পরিবারের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল হওয়ার পরে মায়ের কষ্টি পাথরের মূর্তি বানানো হয়। সেই মূর্তিতেই আজও পুজো চলছে।

মন্দির ঘিরে কিংবদন্তি
-------------------------

ভক্তদের কাছে এই নারনা কালীমন্দির অত্যন্ত জাগ্রত বলেই পরিচিত। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে দেবীর নানা মাহাত্ম্যের কথাও শোনা যায়। বছরভর এই মন্দিরে দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তের আনাগোনা লেগেই থাকে। মনস্কামনা পূর্ণ হলে দেবীকে যথাযথ উপাচারে পূজা দিয়ে যান ভক্তরা। মন্দিরের পাশেই রয়েছে একটি পুকুর। স্থানীয় বাসিন্দারা এই পুকুরকে ‘কালী পুকুর’ বলে থাকেন। এখানে জাল ফেলা, জলে নামা বা অন্য যে কোনও কাজকর্ম করা নিষিদ্ধ। কারণ, ভক্তদের বিশ্বাস এখানে প্রতিরাতে দেবী তাঁর সন্তানদের নিয়ে স্নান করেন।  

সেই প্রাচীনকাল থেকে আজও নাকি প্রতিরাতে ১২/১ টা নাগাদ কালীবাড়ির চত্বরের আশেপাশে শোনা যায় নূপুরের শব্দ। ঐ সময়ে গ্রামবাসীরা কেউ বাইরে বের হন না। শব্দটা তাঁদের সকলের চেনা। নূপুর পায়ে নিজের সন্তানদের নিয়ে পার্শ্ববর্তী ঐ কালী পুকুরে স্নান করতে নামেন স্বয়ং দেবী।

বাৎসরিক বিশেষ পূজা 
---------------------------

এই মন্দিরে প্রতিবছর গুড ফ্রাইডের দিন সারারাত ধরে বাৎসরিক কালীপুজো হয়। সেই রাতে বিপুল ভক্ত সমাগম হয় এখানে। পূজা উপলক্ষে প্রায় একসপ্তাহ ধরে মেলা, কীর্তন, গীতাপাঠ, যাত্রাপালার আসর চলে। সেই দিন অন্নকূট উৎসবও আয়োজিত হয়। মন্দির প্রাঙ্গণেই দুটি উনুন বানিয়ে ভোগ রান্না করা হয়। কথিত আছে, এই মন্দিরে ভক্তসংখ্যা যতই হোক না কেন, দেবীর আশীর্বাদে আজ অবধি কোনওদিন ভোগ কম পড়েনি।

কেন গুড ফ্রাইডেতে পুজো?
---------------------------------

ততদিনে মায়ের নানা অলৌকিক লীলার কথা ছড়িয়ে পড়েছে বহু দূরে। বিভিন্ন ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুদানে তৈরি হয়েছে মায়ের ঠাকুরদালান আর আটচালা। একই গ্রামে পঞ্চানন্দঠাকুরের থানও বিখ্যাত। বাতের উপশমের জন্য এই থানের মাটি নিতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে ভক্তরা। বিশাল মেলা বসে গাজনের সময়। তাই গ্রামে আসা মানুষদের জন্য একটি উৎসবের আয়োজন করার কথা ভাবেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। চাকরির কাজের চাপে কালীপুজোর সময়ে তা হয়ে ওঠেনি। অবশেষে গুড ফ্রাইডেতে মিলল ছুটির অবসর। সেই সময়েই গাজনের আগে একমাসের সন্ন্যাস ব্রতের জন্য বহু সাধুসন্তের সমাগম গ্রামে। তাই সে সময়েই শুরু হল বাৎসরিক পুজো। যে ট্র্যাডিশন আজও চলে আসছে নারনা গ্রামে। শুধু গুড ফ্রাইডে নয়, দ্বীপান্বিতা অমাবস্যার সময়েও অন্য সব কালীপুজোর থেকে এই পুজোর সময় আলাদা। কালী পুজোর অমাবস্যার পর দিন প্রতিপদে শুরু হয় পুজো।

কিভাবে আসবেন
---------------------

এই মন্দিরে যেতে হলে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কোনা হয়ে, জগদীশপুরের ওপর দিয়ে পৌঁছতে হবে। 

ট্রেনে এলে, হাওড়া-আমতা শাখার ডোমজুড় রোড স্টেশনে নেমে টোটোয় আধঘন্টা মতো।

কলকাতার দিক থেকে বাসে এলে, K-11 বাসে ডোমজুড় এসে টোটোয় আধঘন্টা মতো। হাওড়া থেকে আসলেও একই উপায়ে পৌঁছে যাবেন এখানে।

গুগল ম্যাপে 'Narna Kalibari' লিখে সার্চ করলে সঠিক লোকেশন পেয়ে যাবেন।

মন্দিরের সামনের রাস্তা খুব বিশাল চওড়া নয়, চার চাকা নিয়ে এলে পার্কিংয়ের সমস্যা হতে পারে তবে দুই চাকায় সেরকম সমস্যা নেই।

সময় 
------

মোটামুটি সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ১২/১২:৩০ টা অব্দি। ভোগের পর মন্দির বন্ধ থাকে। আবার বিকেলে ৬ টার আশেপাশে সন্ধ্যারতির পর থেকে মোটামুটি সন্ধ্যা ৭:৩০ অব্দি খোলা থাকে।

#howrah #domjur #narna #narnakalibari #kalibari #kalitemple #westbengal #westbengaltourism 


Comments

Popular posts from this blog

হাওড়ার একমাত্র অক্ষত সেমাফোর টাওয়ার

হাওড়ার বেলুড় রাসবাড়ি