দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বোড়ালের ত্রিপুরসুন্দরী মন্দির
কলকাতার গড়িয়ার খুব কাছেই বোড়ালে অবস্থিত এই বহু প্রাচীন মন্দির খুব কম করে হলেও ৭০০-৮০০ বছরের পুরোনো। এই মন্দির ও সংলগ্ন এলাকার ইতিহাস পাল, সেন যুগের এমনকি তার আগেরও অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে এখানে। অনেকের মতে এই মন্দির দেবীর ৫২ সতীপীঠের একটি, এখানে নাকি দেবীর অঙ্গুলিবিহীন বাম করতালু পতিত হয়েছিল।
![]() |
মূল মন্দির |
এই জায়গার ইতিহাস
------------------------------
এই এলাকা আর মন্দিরের ইতিহাস পাল ও সেন যুগের। এককালে এই দেবীর মন্দিরের পূর্ব সীমা দিয়ে বয়ে যেত আদিগঙ্গা ভাগীরথী, আর দেবীর মন্দির ছিল নদীর পশ্চিমকূলে। সমস্ত বণিকরা তাম্রলিপ্ত বন্দর যাবার পথে এই বোড়ালে নেমে, ত্রিপুরসুন্দরীর পিঠে এসে পূজা ও রাত্রিযাপন করতেন। সেন বংশের কেউ একজন (কথিত আছে বল্লাল সেন) মন্দিরের কাছেই সাড়ে বিয়াল্লিশ বিঘার একটি পুকুর কাটান, যার নাম এখন সেনদীঘি।
![]() |
সেন দীঘি |
কালক্রমে মুসলমান রাজত্বকালে মগ ও জলদস্যুদের অত্যাচারে, আর ভাগীরথীর শাখা শুকিয়ে গেলে, দেবীপীঠকে কেন্দ্র করে যে সমৃদ্ধশালী জনপদ গড়ে উঠেছিল, সেটা লুপ্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে মন্দিরও ভগ্নদশা হয়ে যায়। পরবর্তীকালে, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, জগদীশ ঘোষ নামের এক পূর্ববঙ্গীয় ধনী জমিদার এই মন্দিরের সংস্কার করেন ও বোড়াল গ্রামের শ্রীবৃদ্ধি করেন। কিন্তু ওনার মৃত্যুর পরে, আবার সেই মন্দির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
এর পরে, জগদীশ ঘোষের নবম পুরুষ শ্রী হীরালাল ঘোষ একটি সেবায়েতমণ্ডলী গঠন করে, সেই ধ্বংসস্তুপ খনন করে কাঠের বিকলাঙ্গ মূর্তিটি উদ্ধার করেন। কিন্তু সেটি গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে, একটি মাটির মূর্তি গড়িয়ে পূজো হতে থাকে। পরবর্তীকালে, কুমারটুলি থেকে একটি অষ্টধাতুর মূর্তিটি গড়িয়ে আনা হয়, যেটি বর্তমানে পূজিতা।
এই ত্রিপুরসুন্দরী দেবীর প্রাচীন মন্দিরের স্তূপ খনন করে দেখা যায় যে মন্দির ভিত্তির বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধরণের কারুকার্যমন্ডিত ইঁট এবং গাঁথনির বিভিন্ন প্রকার কৌশল রয়েছে। মন্দির সংলগ্ন স্থানে খননকালে খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের নানা প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন থেকে শুরু করে মৌর্য, কুষাণ, গুপ্ত, পাল ও সেনরাজাদের আমলের বহু পোড়া মাটির মাতৃকামূর্তি, যক্ষমূর্তি, খণ্ডিত শিবমূর্তি, বিষ্ণুমূর্তি, উৎকীর্ণ বৃহদাকার শিলা, তারামূর্তি, কালীমূর্তি, নানাধরনের তৈজস পত্রাদি, মাটির মাল্যদানা, ভগ্ন শিব মুখমন্ডল ও শায়িত শিব, হরিণের শিং, অঙ্গারীভূত সুন্দরী গাছের কান্ড, প্রস্তরীভূত হস্তীর কঙ্কাল ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছে।
ত্রিপুরসুন্দরী আসলে কে
---------------------------------
আদ্যাশক্তি মহামায়ার দশটা রূপকে বলা হয় দশমহাবিদ্যা। এই মহাবিদ্যার তৃতীয়া দেবীর নাম ষোড়শী বা নামান্তরে ত্রিপুরসুন্দরী। স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল, এই তিন পুরের কর্ত্রী তিনি। শ্রী শ্রী পঞ্চানন দেব ওনার ভৈরব।
শায়িত শিবের নাভি থেকে বের হওয়া পদ্মের উপর চতুর্ভুজা মূর্তি - পদতলে স্তবরত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, মহেশ্বর ও সদাশিব।
![]() |
মা ত্রিপুরসুন্দরীর বিগ্রহ |
মন্দির চত্বরে কি কি দেখবেন
---------------------------------------
আগের মন্দিরের সংস্কার করে বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করা হয় ২০১৪ সালে।
মায়ের মূল মন্দির ছাড়াও পাশে একটি শিব মন্দির (১৯৯৪ সালের ২৫ মে উদ্বোধন করা হয়েছিল) রয়েছে। সেখানে শিলা দিয়ে পূজা করা হয়। এখানের বিশেষ আকর্ষণ কষ্টিপাথরের বিষ্ণুর অনন্তশয্যার একটি বহু প্রাচীন মূর্তি, যেটি সেনদীঘি থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। আর ঠিক তার পাশেই বট গাছের নীচে একটি বেদি করা আছে, সেখানে তারা মা পূজিত হন। মন্দির সংলগ্ন একটি পুকুর রয়েছে। যেখানে মন্দিরের নানা কাজ করা হয়।
![]() |
পার্শবর্তী শিব মন্দির |
![]() |
শিব মন্দিরের ভিতরের বিগ্রহগুলি। একদম বাঁদিকেরটি সেই কষ্টিপাথরের বিষ্ণুর অনন্তশয্যার বহু প্রাচীন মূর্তিটি যেটি সেনদীঘি থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। |
![]() |
সেই বট গাছ যার নিচে মা তারা পূজিতা |
![]() |
মন্দির সংলগ্ন পুকুর |
উঁচু গেট দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গনে প্রবেশ করলে, বাঁদিকে পুজোর সামগ্রীর একটাই দোকান আছে। সেখান থেকে পুজোর সামগ্রী নিয়ে মাকে পুজো দেওয়া যায়।
![]() |
মন্দির চত্বরে বৈদ্যুতিক বাতি সম্বলিত একটি তোরণ |
মন্দিরের অফিসঘরের পাশে একটা আলমারীতে অনেকগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রাখা আছে, যেগুলো বিভিন্ন সময়ে খননকার্যের সময় পাওয়া গিয়েছে। অধিকাংশ প্রত্নসামগ্রী পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে।
![]() |
বিভিন্ন সময়ে খননকার্যের সময় পাওয়া সেইসব প্রত্নসামগ্রীর কিছু |
![]() |
বিভিন্ন সময়ে খননকার্যের সময় পাওয়া সেইসব প্রত্নসামগ্রীর কিছু |
![]() |
বিভিন্ন সময়ে খননকার্যের সময় পাওয়া সেইসব প্রত্নসামগ্রীর কিছু |
![]() |
বিভিন্ন সময়ে খননকার্যের সময় পাওয়া সেইসব প্রত্নসামগ্রীর কিছু |
মন্দিরের পিছনের গেট দিয়ে বেড়িয়ে কয়েক মিনিটের হাঁটা পথেই দেখে নিতে পারেন সেই ঐতিহাসিক সেন দীঘি।
এই মন্দিরের সাথে জড়িয়ে থাকা এক আশ্চর্য কাহিনী
-----------------------------------------------------------------------
বোড়াল গ্রামে তখন শ্রী জয়হরি মুখোপাধ্যায় নামে দেবীর পুজক ও একনিষ্ঠ একজন সেবক ছিলেন। সেই সময়কালে গ্রীষ্মের দুপুরে এক শাঁখারি সেন দীঘির ঘাটের কাছে বিশ্রাম করছিলেন। এমনসময় এক সুন্দরী মেয়ে সেই শাঁখারির কাছে এসে শাঁখারিকে শাঁখা পড়াতে বলেন। শাঁখারি তার কথা মতো তাকে শাঁখা পড়িয়ে দিলেন। শাঁখা পড়ার পরে মেয়েটির কাছে টাকা চাওয়ায় মেয়েটি বলল, তুমি মন্দিরে যাও আমার বাবা জয়হরির কাছে গিয়ে বলো যে তার ব্যাগে এক টাকা আছে তোমাকে দাম দিতে হবে আর বোলো তোমার মেয়ে শাঁখা পড়েছে। সেই কথা শুনে শাঁখারি জয়হরির কাছে এসে বলল তোমার মেয়ে শাঁখা পড়েছে তার দাম তোমাকে দিতে বলল। জয়হরি মশাই তো এই শুনে অবাক হলেন। আসলে তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। এরপর তিনি যখন সেই শাঁখারিকে সাথে নিয়ে সেন দীঘির ঘাটে যান তখন দীঘির মাঝ বরাবর দেবী তার দুই হাত তুলে তিনি যে শাঁখা পড়েছেন সেটা দেখালেন।
এই মন্দিরের ইতিহাস ও গুরুত্ব
------------------------------------------
এই ত্রিপুরসুন্দরী দেবীর পীঠস্থানে বহু সাধক সিদ্ধিলাভ করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ সাধক শ্রীমৎ স্বামী শিবচৈতন্য গিরি। সাম্প্রতিককালে দেবীর সাধনা করেন শ্রীমৎ স্বামী হরানন্দ সরস্বতী ও জগতগুরু শঙ্করাচার্য ১১০৮ শ্রীমৎস্বরূপানন্দ গিরি।
![]() |
মন্দির চত্বরে হরানন্দ সরস্বতীর সমাধি |
১৩২৫সালে ভূমি জরিপের সময় শ্রী হীরালাল ঘোষ ও ঠাকুর বসন্ত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ত্রিপুরসুন্দরী দেবীর সমস্ত ভূসম্পত্তির সেবাইত রূপে রেকর্ড হয়। ফরতাবাদ ও অন্যান্য স্থানের সম্পত্তিগুলি তদ্বিরের অভাবে বেদখল হয়। তদানুসারে সেই আইনের বলে উক্ত দুইজন ট্রাস্টি ১৩৪১ সালে এক সাধারণ সভায় ৭জন ব্যক্তিকে নিয়ে একটি সর্ব্বসম্মত ট্রাস্ট বোর্ড গঠন করেন। এই কমিটির মারফত দেবীপীঠের উন্নতিমূলক সেবাকার্য হয়। বিশেষ করে প্রায় চার হাজার টাকা খরচ করে দেবীর মাটির মূর্তির বদলে অষ্টধাতুর মূর্তি নির্ম্মিত হয়। নবনির্ম্মিতদেবী বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হয় ২৩শে মাঘ, ১৩৪১সাল, শুক্লা তৃতীয়ার দিন, শ্রী পঞ্চমী বা সরস্বতী পূজার দুইদিন আগে। এই ট্রাস্ট বোর্ড গঠন হলে দেবীর পীঠে বহুকালের প্রচলিত পশুবলি বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ফল পাকুড়ও বলি দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
এই মন্দির নয়টি চূড়া বিশিষ্ট মন্দির অর্থাৎ বলা যায় নবরত্ন মন্দির। উচ্চতা প্রায় ৫২ফুট। এই মন্দিরের সম্পূর্ণ নক্সা করেছেন মার্টিন এন্ড বার্ণ কোং এর ইঞ্জিনিয়ার ঢাকুরিয়া নিবাসী শ্রী সরোজ কুমার চট্টোপাধ্যায়। এই মন্দির ও নাটমন্দির নির্ম্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় একলক্ষ টাকা এবং সময় লেগেছিল প্রায় এক বছর।
বিশেষ উৎসব
-------------------
প্রতি বছর মাঘমাসের শুক্লা তৃতীয়া থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত এখানে উৎসব হয়ে থাকে। এই উপলক্ষে হোমযজ্ঞ, চণ্ডীপাঠ, কীর্তন এবং নর-নারায়ণসেবা করা হয়ে থাকে।
দূর্গাপুজোর ১৫দিন এই মন্দিরে সকালে মঙ্গলারতি হয় এবং প্রতিদিনই নাটমন্দিরে কীর্তন, ভক্তিগীতি এবং গীতাপাঠ হয়। বিশেষ পূজার দিন সকাল ৯টায় শুরু হয় চণ্ডীপাঠ।
সময়
-------
ভোর ৫ টায় মন্দির খোলা হয়।
সকাল ১০:৩০ নাগাদ নিত্য পূজা হয়।
দুপুর ১ টায় দেবীর ভোগান্তে মন্দির বন্ধ করা হয়।
আবার বিকেল ৪ টায় মন্দির খোলা হয়, সন্ধ্যা ৬:৪৫/৭ টা নাগাদ সন্ধ্যারতি হয়, মন্দির বন্ধ হয় সন্ধ্যা ৮ টা নাগাদ।
দেবীর বুধবারে বিশেষ পূজা হয়। বুধবারে বহুমানুষ তাদের গ্রহদোষ কাটাতে এই দেবীপীঠে আসেন।
ভোগ প্রসাদের ব্যবস্থা
------------------------------
এখানে ভোগ প্রসাদ গ্রহণ করতে চাইলে আগের দিন কথা বলে নিন মন্দির কর্তৃপক্ষের সাথে, নম্বর হলো: ৯৯০৩২৬৪৯৪৮|
ভোগ প্রসাদের মূল্য মোটামুটি ১৪৫ টাকা জনপ্রতি।
দিনের দিন কুপন নিতে হলে সকাল ৯ টার মধ্যে চলে আসবেন, সঙ্গে অনেক লোকজন থাকলে অবশ্যই আগে ওনাদের সাথে ওপরে উল্লেখিত নম্বরে কথা বলে নেবেন।
ভোগ প্রসাদ মোটামুটি ভাবে দুপুর ১:৩০ নাগাদ (দুপুরে মাকে ভোগ নিবেদন করার পর ) বিতরণ করা হয়।
কিভাবে আসবেন ও পার্কিং
------------------------------------
মেট্রোয় আসলে কবি নজরুল স্টেশনে নেমে অটোয় বোড়াল হাইস্কুল স্টপেজে নেমে কিছুটা হেঁটে পৌঁছতে পারেন এখানে। বাসে/ট্রেনে গড়িয়া এসেও একইভাবে পৌঁছতে পারেন এখানে। একদম সামনে অব্দি অটোয়/টোটোয় আসতে হলে রিজার্ভ করতে হবে।
সেই অর্থে পার্কিংয়ের কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। বাইক নিয়ে এলে আশে পাশে বুঝে শুনে নিজের দায়িত্বে রাখতে পারেন তবে চার চাকা এখানে না নিয়ে আসাই ভালো। আশে পাশের রাস্তা খুব একটা প্রশস্ত নয় আর হালও বেশ খারাপ।
বিঃ দ্রঃ:
----------
মায়ের বিগ্রহের ছবি নেওয়া নিষিদ্ধ। এখানে যে ছবিটি দিয়েছি সেটা ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত।
#south24parganas #boral #tripursundaritemple #westbengal #westbengaltourism
Comments
Post a Comment