হাওড়ার রামরাজাতলার রাম মন্দির

হাওড়া জেলার রামরাজাতলায় এই মন্দিরটি অবস্থিত, প্রায় ২৫০ (মতান্তরে ৩০০) বছর পুরোনো এই মন্দির। 

মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস 
----------------------------------

সাঁতরাগাছির প্রখ্যাত জমিদার অযোধ্যারাম চৌধুরী রাজবেশধারী রাম-সীতার পুজো প্রবর্তন করার কিছুদিন পর থেকেই রামমন্দির সন্নিহিত এলাকা রামরাজাতলা নামে পরিচিতি লাভ করে ।

কথিত আছে রামভক্ত অযোধ্যারাম চৌধুরী স্বপ্নাদেশে শ্রী রামচন্দ্রের পুজো করার নির্দেশ পান । সেই স্বপ্নাদেশের রূপায়নে তিনি উদ্যোগী হন বিশালাকারে এবং বারোয়ারি পুজোর আদলে রাম-সীতার পূজার্চনা করতে । কিন্তু সেই সময় এই এলাকায় বারোয়ারি সরস্বতী পুজোর খুব খ্যাতি ছিল। স্থানীয়রা এই পুজোয় মেতে উঠতো। ফলে একদল গ্রামবাসী বারোয়ারি রাম পুজোর বিরোধিতা করলেন।

দুদলের ধারাবাহিক আলোচনায় শেষমেষ এই সিদ্ধান্ত হলো যে , রাম-সীতার পুজোই বড় করে হবে, কিন্তু সরস্বতী পুজোর দিন প্রতিমা নির্মাণের সূচনা হবে বাঁশ কাটা এবং প্রারম্ভিক পুজোর মধ্য দিয়ে । আর রামসীতার মূর্তির উপরের দিকে অবস্থান করবেন দেবী সরস্বতী । শুধু তাই নয় , এও স্থির হয় যে , সরস্বতী পুজোর দিন নন্দীপাড়ার একটি বাঁশবাগান থেকে বাঁশ কেটে এনে খুঁটি পুজোর মাধ্যমে প্রতিমা নিমার্ণের সূত্রপাত হবে । সেই নিয়ম আজও চলেছে।

এই রামরাজাতলার সঙ্গে আবার তুলসীদাসের ইতিহাসও জড়িয়ে রয়েছে। শোনা যায় রামভক্ত তুলসীদাসের শিষ্য রামদাস মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। তুলসীদাসের লেখা রামচরিতমানস পড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন রামদাস। তারপরেই তিনি মন্দিরটি তৈরি করেন।

বিগ্রহের কথা 
-------------------

রাবণবধের পরে সপারিষদ রাজা রাম ও সীতার মূর্তি এখানে পূজিত হয় । রাম নবমীর দিন এখানে ২২ ফুট চওড়া ও ১৬ ফুট লম্বা কাঠামোয় তৈরি সুবিশাল মাটির রাম সীতা ও অন্যান্য বিগ্রহের (মোট ২৬টি) পুজো শুরু হয়।

মনে করা হয় রাম কামদেবের মতোই আকর্ষণীয় ছিলেন, কামদেবের গাত্রবর্ণ যেহেতু সবুজ তাই রামও সবুজ। একদম উপরে থাকেন বসুদেব, তারপর পাঁচটি সরস্বতী প্রতিমা ও দুটি সিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রী মায়ের মূর্তি। মাঝের মূল প্যানেলে থাকেন রাম ও সীতা। রামের ডানদিকে থাকেন শিব, বাঁদিকে থাকেন ব্রম্মা। কাঠামোর নিচের অংশে থাকে বিশ্বামিত্র, বাল্মীকি, লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, জাম্বুবান, লব, কুশ প্রমুখের মূর্তি। আলাদা করে একই মন্দিরে পৃথক পৃথক মণ্ডপে পূজিত হন হনুমান, বিষ্ণুর বামন অবতার, সাবিত্রী-সত্যবান ও যমরাজ। রামরাজাতলার রাম-সীতা সম্পূর্ণ বাঙালি গড়নের । বাস্তবে মোটা গোঁফওয়ালা রাম-মহাদেব-ব্রম্ভার মূর্তি গোটা ভু-ভারতে সম্ভবত আর কোথাও নেই।

মন্দিরের মূল বিগ্রহগুলি

হনুমানের মূর্তি

বিষ্ণুর বামন অবতার ও তার সাথে আরো কিছু দেব দেবী, মুনি-ঋষি ও সখীর মূর্তি

সাবিত্রী-সত্যবান ও যমরাজের মূর্তি

বর্তমানে প্রতিবছর সরস্বতী পুজোর দিন ষষ্ঠীতলার নন্দীপাড়ার নির্দিষ্ট বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটার পরে চৌধুরীপাড়ায় শিবমন্দিরে বাঁশ পুজোর মাধ্যমে রামসীতার মূর্তি গড়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয় । এর অল্প কিছুদিন পর থেকেই রামরাজাতলা বাজারের আটচালায় কুমারটুলির প্রতিমা শিল্পী গৌর পালের বংশধররা প্রতিমা নির্মাণ শুরু করে দেন। 

কয়েক বছর আগে পুরাতন মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে আরও তিনটি মন্দির গড়ে তোলা হয়েছে। এই মন্দিরগুলিতে সারাবছর পূজিত হচ্ছেন উত্তর ভারতীয় শৈলীতে গড়া পাথরের রাম-সীতা, বিষ্ণু ও মহাদেব। পুরনো মূর্তির গঠনের সাথে নতুন মন্দিরের পাথরে নির্মিত দেবমূর্তিগুলির কোন মিলই নেই । বরং তা অনেকটাই উত্তর-পশ্চিম ভারতের গঠনশৈলীতে গড়া। শ্রাবনের শেষ রবিবার অন্যান্য ছোট মূর্তিগুলি সহ মূল কাঠামোটি বিসর্জন দেওয়া হলে বছরের বাকি আট মাস আগে মন্দির শূন্য থাকতো কিন্তু নতুন এই মন্দিরগুলি হওয়ার পর থেকে সারা বছরই নিত্যপূজার ব্যবস্থা থাকে।

নতুন রাম-সীতার মূর্তি

নতুন বিষ্ণুদেবের মূর্তি

নতুন মহাদেবের মূর্তি


বাৎসরিক উৎসব ও নিরঞ্জন
-------------------------------------

এই পুজো প্রথমে তিনদিন ,তারপর পনের দিন , আরও পরে একমাস ধরে চলতো। বর্তমানে চৈত্র বা বৈশাখ মাসে রামনবমী তিথিতে শুরু হয়ে শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার পর্যন্ত রাম পুজো ও সেই উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মেলা চলতে থাকে । আগে এই পুজো চলাকালীন প্রতি শনি ও রবিবার যাত্রাপালার আসর বসতো| সেসব এখন আর হয়না ঠিকই ,তবে প্রতিদিন পুজো, ভোগ নিবেদন, সন্ধ্যারতি ইত্যাদি চালু আছে|

শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার চারটি বিশাল প্রতিমা ও তাঁদের অনুচরদের নিয়ে ব্যান্ডপার্টি ও আলোকসজ্জা সহ বিশালাকার শোভাযাত্রা শুরু হয়, মিট হয় সাঁতরাগাছি মোড়ে| সবার আগে থাকেন শমী চণ্ডী , তারপর দুই নবনারী এবং সবার শেষে রামচন্দ্র। নিরঞ্জন হয় হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর ঘাটে।

জনশ্রুতি আছে, রাম বিসর্জনের সময় ট্রামের তার ছিঁড়ে যাওয়ার জন্য ইংরেজ সরকার এই শোভাযাত্রার রাস্তা পরিবর্তনের কথা বলে, তবে জনতা তা কোনওভাবেই তা মেনে না নেওয়ায় ইংরেজ সরকার সেই তার খুলে ফেলতে বাধ্য হয়।


এই মন্দির ও মা সারদা 
---------------------------------

১৯০৯ সালে রামকৃষ্ণের শিষ্য নবগোপাল ঘোষের বাড়িতে আসার সময় মা সারদা এই মন্দিরে আসেন রামচন্দ্রের দর্শনে । মন্দিরের পাশের পুকুরে পা ধুয়ে তিনি রামমন্দিরে প্রবেশ করেন ও শ্রীরামচন্দ্রের মূর্তি দর্শন করেন। সেই পুকুরের অবশ্য অস্তিত্ব নেই বর্তমানে ।


সময় ও ভোগের ব্যবস্থা 
---------------------------------

প্রত্যেকদিন সকাল ৬-৬:৩০ থেকে রাত ৯টা অব্দি খোলা থাকে মন্দির। পূর্ণিমার দিনগুলোয় বিশেষ পুজো হয় এই মন্দিরে। পুজো দেওয়ার ডালা মন্দির চত্বরের দোকানগুলি থেকেই কিনতে পারবেন।

ভোগের কুপন সকাল ৭ টা থেকে ১০ টার মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে। মূল্য:

 অন্ন ভোগ: ২৫০ টাকা 

রাতে লুচি ভোগ: ২০০ টাকা 

পায়েস ভোগ: ২৫০ টাকা 

মন্দির চত্বর

কিভাবে আসবেন
-------------------------

ট্রেনে এলে  নামতে হবে হাওড়া-মেদিনীপুর/খড়্গপুর/পাঁশকুড়া/মেচেদা/উলুবেড়িয়া শাখার রামরাজাতলা স্টেশনে। সেখান থেকে কিছুটা পায়ে হেঁটে আসলেই পৌঁছে যাবেন এই মন্দিরে। 

এছাড়া হাওড়া থেকে যদি বাসে (যেমন রুট নম্বর ৫২) আসেন (কলকাতা থেকেও), তাহলে সাঁতরাগাছি মোড় অথবা জানাগেটে নামতে হবে। সেখান থেকে এক টোটোতেই পৌঁছে যাবেন মন্দিরের দ্বারে।

গুগল ম্যাপে 'Ramrajatala Ram Temple' লিখে সার্চ করলে সঠিক লোকেশন পেয়ে যাবেন।

মন্দির একদম মেইন রাস্তার ধারে বাজার এলাকায়, সেই অর্থে পার্কিংয়ের কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। বাইক নিয়ে এলে আশে পাশে বুঝে শুনে নিজের দায়িত্বে রাখতে পারেন তবে চার চাকা এখানে না নিয়ে আসাই ভালো।

#howrah #ramrajatala #ramrajatalaramtemple #westbengal #westbengaltourism

Comments

Popular posts from this blog

হাওড়ার একমাত্র অক্ষত সেমাফোর টাওয়ার

হাওড়ার বেলুড় রাসবাড়ি

হাওড়ার ডোমজুড়ের নারনা কালীবাড়ি